The Sundarbans is a natural region in Bengal. It is the largest single block of tidal halophytic mangrove forest in the world. The Sunderbans is approximately 10,000 km2 of which 60% is located in Bangladesh with the remainder in India The Sundarbans National Park is a National Park, Tiger Reserve, and a Biosphere Reserve located in the Sundarbans delta in the Indian state of West Bengal. Sundarbans South, East and West are three protected forests in Bangladesh.

সুন্দরবনের বৈচিত্র প্রাণী সম্পদ ও বনজীবিদের সুখ-দুঃখ

28
বিশেষ ডেস্ক : সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন হল সুন্দরবন। যেটি কিনা গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত। প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশ অংশে এবং বাকীটুকু পড়েছে ইন্ডিয়াতে। সুন্দরবনকে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষনা করে। এখানে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবনাক্ততা সহ ছোট ছোট দ্বীপ এবং নদী। এর মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি এবং বিল। বনভূমিটি বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত।
জরিপ মোতাবেক এই সুন্দরবনে প্রায় ৪৪০ বাঘ ও ৩০,০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে। হাজার বছর ধরে বঙ্গোপসাগর বরাবর আন্তঃস্রোতীয় প্রবাহের দরুন প্রাকৃতিকভাবে উপরিস্রোত থেকে পৃথক হওয়া পলি সঞ্চিত হয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। এর ভৌগোলিক গঠন ব-দ্বীপীয়, যার সমুদ্রসমতল থেকে সুন্দরবনের উচ্চতা স্থানভেদে ০.৯ মিটার থেকে ২.১১ মিটার। সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়া গাছ। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইন এর হিসেব মতে সর্বমোট ২৪৫ টি শ্রেণী এবং ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এখানে। পুরো অঞ্চল জুড়ে সুন্দরী ও গেওয়া এর প্রাধাণ্যের পাশাপাশি বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে ধুন্দল এবং কেওড়া। ঘাস ও গুল্মের মধ্যে শন, নল খাগড়া, গোলপাতা ইত্যাদি। সুন্দরবনের মাছের ওপর তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। ফলে মাছের বর্তমান অবস্থা, বিলুপ্ত মাছ, বিলুপ্তপ্রায় মাছের ওপর উপাত্ত নির্র্ভর তথ্য পাওয়া যায় না না।
108006
শুধু মানুষ যেসব মাছ খায় এবং যেসব মাছ রপ্তানি উপযোগী, সেসব মাছ চিহ্নিত করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, সুন্দরবনে শিড়দাঁড়াওয়ালা মাছ রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির। সাইডেনস্টিকার ও হাই-এর (পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭৮) মতে, এর মধ্যে বাণিজ্যিক মাছ ১২০ প্রজাতির; অবশ্য বার্নাকসেকের মতে, (২০০০) বাণিজ্যিক মাছ ৮৪ প্রজাতির, কাকড়া ও চিংড়ি ১২ প্রজাতির ও ৯ প্রজাতির শামুক রয়েছে। সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সব মাছ মিলিয়ে হয় সাদা মাছ আর বাকিরা বাগদা, গলদা এবং কাঁকড়া। আশির দশকে চিংড়ির পোনা ধরা শুরু হওয়ার পর থেকে মাছের প্রাচুর্য হঠাৎ কমে যায়। একসময় স্থানীয় জনসাধারণের প্রাণিজ প্রোটিন ৮০ ভাগই মেটাতো সুন্দরবনের মাছ। কিন্তু এখন মাছ খাওয়ার সৌভাগ্য এলাকার খুব কম লোকেরই ভাগ্যে জোটে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে যেমন, ঠিক তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এই বন কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এছাড়াও কাঠ, জ্বালানী ও মন্ডের মত প্রথাগত বনজ সম্পদের পাশাপাশি এ বন থেকে নিয়মিত ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয়, ঘর ছাওয়ার জন্য গোলপাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক-ঝিনুক। বৃক্ষপূর্ণ সুন্দরবনের এই ভূমি একই সাথে প্রয়োজনীয় পাআবাসস্থল, পুষ্টি উৎপাদক, নি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শক্তি-সম্পদের আধার এবং পর্যটন কেন্দ্র। বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫১ শতাংশ জুড়ে সুন্দরবন, বন থেকে আসা মোট আয়ে অবদান প্রায় ৪১ শতাংশ এবং কাঠ ও জ্বালানী উৎপাদনে অবদান প্রায় ৪৫ শতাংশ (বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, ১৯৯৫)।
নিউজপ্রিন্ট, দেয়াশালাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা, আসবাবপত্র ইত্যাদি শিল্প সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন অ-কাঠজাত সম্পদ এবং বনায়ন কমপক্ষে আধা মিলিয়ন উপকূলবর্তী জনসংখ্যার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃস্টি করেছে। উৎপাদনমূখী ভূমিকার পাশাপাশি সুন্দরবন, ঘূর্নিঝড় প্রবণ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনসংখ্যা ও তাদের সম্পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবলয় হিসেবে ভূমিকা রাখে। মানুষের বসবাস ও অর্থনৈতিক কাজে ব্যাপক ব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও এখনো সুন্দরবনের ৭০% শতাংশের কাছাকাছি পরিমাণ বনভূমি টিকে আছে, ১৯৮৫ সালে এমন মত জানায় যুক্তরাজ্যের ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশন (ও ডি এ)।
deer
বাংলাদেশ এবং ভারত জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের বৃহত্তর অংশটি (৬২%) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর; পূর্বে বালেশ্বর নদী আর উত্তরে বেশি চাষ ঘনত্বের জমি বরাবর সীমানা। উঁচু এলাকায় নদীর প্রধান শাখাগুলো ছাড়া অন্যান্য জলধারাগুলো সর্বত্রই বেড়িবাঁধ ও নিচু জমি দ্বারা বহুলাংশে বাঁধাপ্রাপ্ত। বর্তমানে মোট ভূমির আয়তন ৪,১৪৩ বর্গ কি.মি. এবং নদী, খাঁড়ি ও খালসহ বাকি জলধারার আয়তন ১,৮৭৪ বর্গ কি.মি. । সুন্দরবনের নদীগুলো নোনা পানি ও মিঠা পানির মিলন স্থান। সুতরাং গঙ্গা থেকে আসা নদীর মিঠা পানির, বঙ্গপোসাগরের নোনা পানি হয়ে ওঠার মধ্যবর্তী স্থান হলো এ এলাকাটি। এটি সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী অঞ্চল জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশে।
খুলনা জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলার মধ্যে কয়রা অন্যতম একটি। কয়রা উপজেলা ৭ টি ইউনিয়নের মধ্যে, কয়রা ইউনিয়ন হল সুন্দরবন সংলগ্ন একটি ইউনিয়ন। ইউনিয়নটির পূর্বে- সুন্দরবন, পশ্চিমে- কপোতাক্ষ নদ, উত্তরে- মহারাজপুর ইউনিয়ন এবং দক্ষিণে- উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন। ইউনিয়নটির মোট জনসংখ্যা ৪৫,৮৫০ জন (আদমশুমারী ২০১১ প্রতিবেদন) এবং আয়তন- ৩৩.৩৮ বর্গ কিলোমিটার। এই ৩৩.৩৮ বর্গ কিলোমিটারে গ্রাম রয়েছে ১৩ টি। এই ১৩ টি গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম হল ৩ নং কয়রা। গ্রামটির জনসংখ্যা প্রায় ১৮৭২ জন (আদমশুমারী ২০১১ প্রতিবেদন)। গ্রামটির বেশির ভাগ মানুষ পেশায় বনজীবি।
images (3)
৩ নং কয়রা গ্রামটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে গ্রামটির অবস্থা খুবই নাজুক এবং রুগ্ন। গ্রামের প্রায় সকল বাড়ি ঘর কাচা। বাঁশ এবং গোলপাতা দিয়ে তৈরি কতটা ঝুপড়ি ঘর গুলোর মত। পুরো গ্রামে কোথাও একটা বিল্ডিং খুজে পাওয়া দুষ্কর শুধু জাপান সরকারের অর্থায়নে তৈরি করা একটি একতলা পাকা মসজিদ ছাড়া। তাও আবার এই মসজিদ তৈরির ৮ লক্ষ টাকা আনতে দুই লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে গ্রামবাসীদের। রাস্তা ঘাটের অবস্থা এতই খারাপ যে মোটর সাইকেল তো দূরের কথা পায়ে হেটে চলাচল করাই বেশ কষ্টকর। মোটর সাইকেল বাহনটিকে এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রাস্তা গুলোতে শেষ কবে ঢালাইয়ের কাজ করা সেটা গ্রামবাসীরা ঠিক মনে করে উঠতে পারে না। ইটের খোয়া আর ইট জায়গায় জায়গায় উঠে গিয়ে একটু পরপর তৈরি হয়েছে গর্ত। খালি পায়ে হাটতে গেলে পা কেটে যায়। আর এই বাজে অবস্থার কারনে এসব রাস্তায় ভ্যান, রিক্সা চালানোর সাহস সহসা কেউ করে উঠে না। শুধু রাস্তা কিংবা গ্রামের অবস্থাই নাজুক নয়, অনাহারে অর্ধাহারে নাজুক অবস্থা এই গ্রামে বসবাসকারী মানুষগুলোরও। একজন বহিরাগত হিসেবে কেউ যদি তাদের যে কারো সাথে যে কোন বিষয়ে কথা বলা শুরু করে তবে সেই গল্প গিয়ে শেষ হয় আইলাতে গিয়ে কারন আজো আইলা এদের জীবনের একটা কালো অধ্যায় হয়ে রয়েছে।
২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলা’র তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল খুলনার দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা, বাগেরহাটের রামপাল, মংলা, শরণখোলা উপজেলাসহ গোটা দক্ষিণ উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ। আইলার আঘাতে উপকূলীয় ১১ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় খুলনা জেলার দাকোপ ও কয়রা উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা। আইলার ফলে এই চার উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী, মহেশ্বরীপুর ও কয়রা সদর ইউনিয়ন, দাকোপ উপজেলার সুতারখালি ও কামারখোলা ইউনিয়ন, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন, এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন। সরকারি হিসেবে, ‘আইলা’র আঘাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৩০ জন। এছাড়া আইলার আঘাতে শারিরীক ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয় ৭ হাজার ১শ’ ৩ জন মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১৩ হাজার সাতশ’ ৭৪টি। পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো নয় লক্ষ ৪৮ হাজার ছয়শ’ ২১টি এবং মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৯ লক্ষ ২৮ হাজার দু’শত ৩০ জন। আইলায় লবণাক্ত পানি ঢোকায় দুর্গত এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় স্বাদু পানির মাছ, গোচারণ ভূমি। গাছপালা মরে বিরাণভূমিতে পরিণত হয়। (সূত্র- সংবাদপত্রের খবর) ৩ নং কয়রা গ্রামের ও তার আশেপাশের গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ পেশায় বনজীবী। তারা সুন্দরবনে গিয়ে নদীতে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ির পোনা, মধু আহরন করে জীবিকা নির্বাহ করে। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ যে পেশায় বনজীবি অনেক আগে থেকেই ছিল, বিষয়টা তেমন না। এদের মধ্যেও ছিল নানা বৈচিত্রের পেশাজীবী। কিন্তু এক আইলা তাদের জীবন লন্ডভন্ড করার পাশাপাশি পরিবর্তন করে দিয়েছে তাদের পেশা, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি এবং অন্যান্য সকল কিছু। আইলার কারনে এই অঞ্চলের কৃষি জমিতে প্রচুর লবন চলে আসে সে সময়। আর যার ফলাফল হল, হাজার হাজার বিঘা কৃষি জমিতে আবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর আবাদ বন্ধ হওয়ায়, এলাকার বিশাল একটা জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়ে। আইলার পূর্বে কিছু মানুষ ছিল কৃষি দিনমজুর, কেউ ছিল বনজীবি। আবার যখন বনে যাওয়ার সিজন থাকত না তখন বেশির ভাগ বনজীবীই অন্যের জমিতে দিন মজুরীর কাজ করত। কৃষি কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারনে বিশাল একটা জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পরে। আর এর ফলাফল হয়, অভাব আর অভাব। মানুষজন নিকটবর্তী শহর গুলোতে এমনকি বেনাপোল হয়ে দালাল ধরে ভারতে পর্যন্ত সিজনাল মাইগ্রেশন শুরু করে। নিকটবর্তী শহর গুলোতে রিক্সা-ভ্যান চালানো, রাজমিস্ত্রির কাজ ইত্যাদি কাজ করে। আর ভারতে গিয়ে তারা কাজ নেয় ইট ভাটায়।
article-2585932-1C75372C00000578-828_964x636
আইলার পরপর সময়ে এই অঞ্চলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেনী। কারন এই সময় সরকারী, বেসরকারী, এন জি ও থেকে প্রচুর সাহাজ্য এসেছে আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের জন্য। মধ্যবিত্ত এই শ্রেনীর লোকজন নিজেদের আত্ম মর্যাদা- মান সম্মানের কারনে রিলিফের লাইনে গিয়ে দাড়াতে পারেনি, আর তার সাথে শেষ সম্বল বিঘা কয়েক জমি লবনে নষ্ট হয়ে যাওয়া তো থাকছেই। প্রভাবশালীরা রিলিফ আত্মসাৎ করেছে আর দরিদ্ররা রিলিফ খেয়েছে। কিন্তু ফাপরে পরেছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেনী। এই অঞ্চলের নারীরা আইলার আগে ছিল খুব বেশি পর্দাশীল। একজন নারী ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করবে এটা কখনো কেউ মেনে নিতে পারতো না। আর নারীরাও মনে করত আসলে এমনই হয়। নারীদেরকে ঘরেই কাজ করতে হবে। একটা নারীর জন্য ঘর- সংসার ই সব বরং বাইরে গিয়ে কাজ করা হল গোনাহ এর কাজ। কিন্তু এক আইলায় তাদের সব ধরনের ধ্যান- ধারনা পরিবর্তন করে দেয়। আইলা পরবর্তী সময়ে, ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন গুলো এসে রিলিফ কিংবা কাজ দেয়া শুরু করে নারীদেরকে টার্গেট করে। আর নারীরাও এই সকল অভাবী পরিবার গুলো থেকে ক্ষুধার তাড়নায় বের হতে থাকে। তারা যুক্ত হয় এন জি ও গুলোর ট্রেনিং, ঋন, রিলিফ কিংবা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী গুলোতে। যেটা ডেভেলপমেন্টের ভাষায় ‘উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’, নারীরা এই তথাকথিত ‘উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’ ডিসকোর্সে যুক্ত হতে থাকে।
এক আইলা এসে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম, রীতি নীতি, পেশা, মুভমেন্ট, রাজনীতি সব কিছুর পরিবর্তন করে দেয়। আইলার সময় এখানে মাছের কোন কমতি ছিল না, কিন্তু মাছ রান্নার চুলা ছিল না। আর আইলার পরেও মাছের প্রাচুর্য্য থাকলেও সেই মাছ মানুষ কিনে খেতে পারত না কারন টাকা নেই। মাছ খেতে হলে নদীতে ধরে খেতে হত। এই এলাকার বেশ কয়েকটা বাজার বিগত কয়েক বছর ধরে (২০১১,২০১২,২০০১৩) পর্যবেক্ষন করে দেখা গেছে, সেখানে ছোট তেলাপিয়া মাছ ছাড়া আর কোন মাছ খুব বেশি উঠতে দেখা যায় নাই। তেলাপিয়া মাছের দাম অন্য মাছের তুলনায় অনেক কম এবং সহজলভ্য। সুন্দরবনে ধরা পরা বেশির ভাগ মাছ চলে যায় শহরে। ৩ নং কয়রা গ্রামের ঝিলিঘাটা বাজারে একদিন এক ছোট বাচ্চাকে (৭/৮ বছর) তেলাপিয়া মাছ বিক্রি করতে দেখা যায়। তাকে যখন মাছের কেজি কত জিজ্ঞেস করা হয়। সে নিশ্চুপ থাকে, কোন উত্তর দেয় না। তাকে তিনবার জিজ্ঞেস করা হয় তোমার মাছের কেজি কত খোকা? সে নিশ্চুপ থাকে, কোন উত্তর দেয় না। সে প্রশ্ন বোঝে নাই। পরে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় মাছের পোয়া কত তখন সেই শিশু উত্তর দেয় ২০ টাকা। এখানে বিষয়টা এমন যে এই এলাকার মানুষ অভাবের কারনে, তারা মাছ কেজি হিসেবে কিনে না দীর্ঘ দিন। কিনে পোয়া হিসেবে। আর তাই সেই শিশুটি কেজি নামক এই বাটখারাটার সাথে পরিচিত নয়। বাজারটিতে মিষ্টি, জিলাপী, খুরমার একটি দোকান রয়েছে। এখানে মিষ্টি বানানোর একটা বিশেষত্ব আছে এখানে। মিষ্টি তৈরি হয় দুধ ছাড়াই। কারন আইলায় এই এলাকার গরু ছাগল সব নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনে এখানে দুধের দাম আর সোনার দাম সমান তাই এখানকার দোকানে মিষ্টি বানানো হয় সামান্য গুড়া দুধ, ময়দা আর চিনি দিয়ে। সামান্য গুড়া দুধ আর ময়দা এক সাথে মিশিয়ে গোল গোল করে তা চিনির শিরার মধ্যে ডুবিয়ে দেয়া হয়, ব্যাস হয়ে গেল মিষ্টি।
খাবার পানির সমস্যা এই এলাকার পুরোনো সমস্যা। এখানকার পানি পুরাই স্যালাইন। স্থানীয়রাও মুখে দিতে পারেন না এই পানি। আইলার পর তা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। খাবার এবং রান্নার জন্য তাই তাদের বৃষ্টির পানির উপর নির্ভরশীল হতে হয়। বর্ষার সিজনে তারা বড় বড় কলস কিংবা ট্যাংকিতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখেন। অথবা একটু দূরে কাছারী বাড়ি নামে একটি বাজার আছে, সেই বাজারের পুকুর থেকে তারা ড্রামে ভরে নৌকায় করে ব্যবহারযোগ্য পানি নিয়ে আসে। ধোয়া এবং গোসলের জন্য এই এলাকার মানুষ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট নদীটির (খাল) উপর নির্ভর। শুধু যে তারা নদীটিতে ধোয়া এবং গোসলই করেন তা নয়। নদীটিতে তারা মাছ ধরে আবার এটাকে রুট হিসেবে ব্যবহার করেন। নৌকা ভাসিয়ে চলে যান দূর-দূরান্তে। নদীটি এসেছে সুন্দরবনের শাক বাড়িয়া নদীর ছোট একটা শাখা নদী হিসেবে।
আইলার কিছু পরে লবন মিশ্রিত জমিতে, কিছু এন জি ও এখানে সাস্টেইনেবেল কৃষির চেষ্টা করেছিল এবং এখনো করছে। এর পদক্ষেপ হিসেবে তারা লবন সহিষ্ণু বীজ চাষিদেরকে প্রদান করছেন। এলাকার যে দু চারজন ঘের চাষী আছেন, তারাও খুব একটা ভাল নেই। এর মূল কারন হল ভাইরাস। আগে তারা এমন সমস্যায় পড়তেন না বলে তারা জানান। কিন্তু হ্যাচারীতে তৈরি হওয়া চিংড়ির রেনু আসার পর থেকেই নাকি তারা এই ভাইরাসের মুখোমুখি হচ্ছেন। আগে তারা জঙ্গলের নদীতে ধরা রেনু চাষ করতেন। কিন্তু এখন সেই রেনুর দাম অনেক বেশি। আবার খুব একটা পাওয়াও যায় না। ভবিষ্যৎ লস কিংবা অধিক লাভকে সামনে রেখে, তারা নতুন একটা ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন- চিংড়ি ঘেরেই ধান চাষ। অর্থ্যাত একই সাথে চিংড়ি এবং ধান চাষ শুরু করেছেন তারা।
৩ নং কয়রা গ্রামটিতে দুটো পাড়া। একটা সর্দার পাড়া আর একটা গাজী পাড়া। সর্দার পাড়ায় থাকেন সর্দারেরা আর গাজী পাড়ায় গাজীরা। যদিও কয়েক দশক পূর্বে এই দুই গোষ্ঠী অর্থ্যাৎ গাজী আর সর্দারদের মধ্যে সব সময় কোন বংশ দল বেশি সম্ভ্রান্ত, এটা নিয়ে একটা কলহ লেগেই থাকত, একদল আরেক দলের সাথে কোন আত্মীয়তা অথবা সম্পর্কের ধারে কাছেও যেত না, দুই দলই নিজেদের সম্ভ্রান্ত এবং অন্য দলকে খাটো করে দেখত । কিন্তু কালের পরিক্রমায় তাদের মধ্যকার সেই প্রতিযোগীতা নিঃশ্বেস হয়েছে অনেক আগেই । তারা জানান, আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই পার্থক্য করত, কারন তাদের টাকা-পয়সা আর সম্পদের প্রাচুর্য্য ছিল। এটা তাদের মানায় কিন্তু আমাদেরকে মানায় না। আমাদের নিজেদের টিকে থাকাই হচ্ছে আমাদের জন্য সব থেকে বড় প্রতিযোগীতা। গ্রামের দুই অংশে, এই দুই গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা পুঞ্জিভূত অবস্থান, মনে হয় যেন (গাজী পাড়া আর সর্দার পাড়া) আজো সেই বিভক্তির সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। সেই দিন গত হয়েছে অনেক আগেই। সর্দার আর গাজী, তারা এখন একই সূত্রে গাথা। বংশানুক্রমে তারা বনজীবী। এই জঙ্গলকে ঘিরেই তাদের সব স্বপ্ন, আশা, আকাংখা। জঙ্গল হল তাদের কাছে খুবই পবিত্র একটা সত্ত্বা। আর পবিত্র সত্ত্বা বলেই, জঙ্গলের ক্ষেত্রে তারা মেনে চলে হাজারটা নিয়ম। এই এলাকার নারীদের জঙ্গলে যাওয়া কঠিন ভাবে নিষেধ। কারন নারীরা সব সময় পাক-পবিত্র থাকতে পারেনা, যেহেতু জঙ্গল পবিত্র একটা এলাকা, তাই সেখানে অপবিত্র কারো প্রবেশ সম্পূর্ন রুপে নিষিদ্ধ, এবং এই নিষেধাজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে এই অঞ্চলের নারীরা। জঙ্গলে যাওয়া তো দূরের কথা, এটা তারা কখনো কল্পনাতেও নিয়ে আসে না। আর তাই জঙ্গলের খুব কাছে থেকেও তারা তাদের পিতা,ভাই অথবা স্বামীদের কাছে থেকে শুনে যায় জঙ্গলের গল্প, বাঘ-ভাল্লুকের গল্প, জঙ্গলে থাকা খারাপ মানুষেদের গল্প । জঙ্গলের গল্প শুনতে শুনতে অবস্থা এমন হয়েছে এ সব নারীদের যে, জঙ্গল যেন তাদের নখদর্পনে। বাড়ির পুরুষটা যখন জঙ্গলে যায়, তখন সব থেকে বেশি উৎকন্ঠায় থাকে এই ‘অপবিত্রা’ নারীটিই। এবং তাই তারা জঙ্গলে যাবার সময় এটা নিশ্চিত করে যে, তার পুরুষটি যাবার সময় হাতে কিংবা গলায় পীরের পড়ে দেয়া তাবিজ, মাদুলি ঝুলিয়ে নিল কিনা অথবা পড়ে দেয়া লাল রুমালটা সাথে নিল কিনা। এলাকার মানুষের দৃঢ় একটা বিশ্বাস যে, পীর সাহেবের পড়ে দেয়া এসব মাদুলী, তাবিজ কিংবা লাল রুমাল তাদের সাথে থাকলে জঙ্গলের বাঘ-ভাল্লুক তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। এই মাদুলী, তাবিজ কিংবা লাল রুমাল পড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সমসাময়িক সময়ে, সব থেকে জনপ্রিয় পীর হলেন সাতক্ষীরার হাসান হুজুর। কথিত আছে যে, এই হাসান হুজুর এমনই একজন আলেম ওলামা, যে তাকে একই সময়ে, একই সাথে একাধিক জায়গায় ওয়াজ করতে দেখা গেছে। জঙ্গলে যাবার আগে এই সকল বনজীবী দলে দলে সাতক্ষীরা গিয়ে অথবা কারো মাধ্যমে ৫০/৬০ টাকা হাদিয়া প্রদানের মাধ্যমে হাসান হুজুরের কাছ থেকে তার পড়ে দেয়া তাবিজ, মাদূলী অথবা পড়া লাল রুমাল নিয়ে আসেন। পীর সাহেবের পড়ে দেয়া এসব মাদূলী,তাবিজ অথবা লাল রুমালে আদৌ কোন কাজ হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে গ্রামের প্রবীন, আনু গাজী একটা গল্প বলেন, ‘তার বাবা এবং তার দাদা একবার জঙ্গলে গিয়ে মাছ ধরতে ধরতে বাদায় (জঙ্গলের স্থল অংশ) একটা বড় মৌচাক দেখতে পান। তো তারা মৌচাকটা কাটার উদ্দেশ্যে বাদায় উঠেন। আশে পাশেই যে মামা (বাঘ) ছিলেন তারা সেটা ঠাহর করতে পারেন নাই। তার ভাষায়, আমার বাবা গাছে উঠেছেন চাক নামাতে আর নিচে দাদু। ঠিক সেই সময় মামা এসে হাজির। মামা মুখ হা করে যেই দাদুর দিকে লাফ দিয়েছে, অমনি দাদু মামাকে (বাঘকে) বলে উঠেন, থাম। মামা দাদুকে ধরে ঠিকই, কিন্তু মুখ তার কাপটি লেগে যায়। হা করা মুখ সে আর বন্ধ করতে পারেনা। অবশেষে মামা দাদুকে ছেড়ে দিয়ে দৌর দিয়ে, জান নিয়ে পালিয়ে যায়। আর এর কারন হল, সে সময় দাদুর কাছে পীর সাহেবের পড়া রুমাল ছিল। তিনি বলেন, তিনি এই গল্প শুনেছেন তার বাবার কাছ থেকে।’ আসলে জঙ্গলের এমন হাজারটা গল্প শোনা যায়, এসব বনজীবী দের কাছ থেকে। যে গল্প চলতে থাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।
শুক্রবারটা এসকল বনজীবীদের কাছে খুব পবিত্র একটা দিন। তারা কেউ শুক্রবারে জঙ্গলে যান না। আর যারা জঙ্গলের নদীতে মাছ ধরার কাজে থাকেন তারাও এই দিনটিতে জঙ্গলে উঠেন না। কারন হিসেবে তারা মনে করেন এই দিনটিতে এখানকার যত প্রানী, উদ্ভিদ আছে তারা সকলেই ইবাদতে মশগুল থাকে। এসময় তাদের কে বিরক্ত করা অনেক বেশি গোনাহ এর কাজ হিসেবে পরিগনিত হয় তাদের কাছে। বনজীবীরা জঙ্গলে মাছ ধরতে যায় গোন হিসেব করে। এটা আসলে নির্ভর করে জোয়ার ভাটার উপর। তারা কেউ নিজের নৌকা নিয়ে যায়, আবার কেউ অন্যের নৌকায় ‘জন’ (দিনমুজুর) হিসেবে যায়, আবার কেউ নিজের নৌকা না থাকায় অন্যের নৌকা ভাড়া নিয়ে যায়। নৌকা ভাড়া ৭ দিন তথা এক গোনের জন্য ১০০০-১২০০ টাকা আর জন হল দিন ১৫০/২০০ টাকা এবং খাওয়া। যাবার সময় এরা নৌকায় চাল-ডাল, লবন, তরি তরকারী, চুলা, খাবার পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নেয়। একটা নৌকায় দুইজন করে মানুষ যায়। নৌকাটি ডিঙ্গি নৌকার থেকে একটু বড়। এই নৌকার খোলে একপাশে ছোট্ট করে তক্তা দিয়ে তৈরি একটা খাট এবং অন্য কিনারে রান্নার জন্য চুলা। জঙ্গলে গিয়ে মাছ ধরা এই সকল জেলে বৈশাখ,আষাঢ় এবং জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাস গলদা চিংড়ির রেনু ধরে। শীতের তিন মাস তারা পাইস্যা (স্থানীয় ভাষায়) মাছের পোনা ধরে। আর বছরের বাদ বাকী সময় তারা বাগদার পোনা, কাকড়া এবং সাদা (অন্যান্য বড় মাছ) মাছ ধরে। জঙ্গলে ক্রমাগত মাছ/কাকড়া ধরতে থাকে এইসব জেলে। মাছ/ কাকড়া ধরে যখন তারা ফেরত আসে, তখন তারা আগে চলে যায় খালের (নদীর পাশে যেখান থেকে ছোট নদী বের হয়েছে তার কিনারে) গোড়ায়, কাঠকাটা অথবা জরসিং এ বিক্রির উদ্দেশ্যে। নদীপথেই যায় তারা এই সব জায়গায়। এই তিন জায়গায় নদীর কিনারে রয়েছে ছোট ছোট অনেক গুলো ঘর যেগুলোতে মাছ, পোনা, কাকড়া ক্রয় করা হয়। বনজীবীরা তাদের ধরা মাছ/পোনা/কাকড়া এখানে বিক্রি করে দিয়ে, টাকা নিয়ে যার যার বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে যে এমনটা হয়, তা না। বনজীবী দের ঋন দেবার জন্য এই এলাকায় রয়েছে ‘কোম্পানি’, কোম্পানি আসলে কোন প্রতিষ্ঠান নয়। এরা আসলে বিশেষ একজন ব্যাক্তি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকেও খারাপ এই কোম্পানি। বনজীবীদের ‘উদ্ধার’ করতে ছোট্ট এই এলাকাতে রয়েছে দেড়শ থেকে দুই শ র ও বেশি কোম্পানি। যে সকল মানুষ এই এলাকায় বনজীবীদের ঋন সুবিধা দিয়ে জঙ্গলে পাঠায় তাদেরকেই এই এলাকার মানুষ জন কোম্পানি বলে। এই সকল কোম্পানি এখানকার বনজীবীদের ঋন, নৌকা, জাল ইত্যাদি সরবরাহ করে এই শর্তে যে, যেই বনজীবী তাদের কাছ থেকে ঋন নিবে, তাকে ঋন পরিশোধ করতে হবে তার কাছে মাছ/কাকড়া/পোনা বিক্রি করতে হবে তার ধরে দেয়া দামে (যেটা বাজার মূল্য থেকে অনেক কম) এবং এর সাথে আরো যুক্ত হয় যে, এই সকল কোম্পানি আবার তাদের ঋন প্রদানকৃত সেই টাকার সুদ হিসেবে তাদের কাছ থেকে, মাছ ক্রয় করার পরও (তার ধরে দেয়া দামে) আরো কিছু টাকা কেটে রাখবে। আবার তথাকথিত এই সব ‘কোম্পনি’ অর্থ ছাড়াও অভাবী বনজীবীদের নৌকা, জাল ইত্যাদিও প্রদান করে থাকে, আর তার শর্ত হয় আরো কঠিন।
বাঘকে এরা মোটেই ভয় পায় না। বাঘের সাথে এদের সম্পর্ক হল মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক। কয়রা উপজেলার কয়রা, বেদকাশী এই দুই ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ বনজীবি, বংশানুক্রমে তারা কেউ গাজী, কেউ সর্দার। সুন্দরবনে গিয়ে তারা কেউ কাকড়া ধরে, কেউ সাদা মাছ ধরে আবার কেউ চিংড়ির পোনা ধরে। এর মাঝে মাঝে তারা মধু ও সংগ্রহ করে যদি চোখের সামনে পড়ে যায়। মাঝে মাঝে ফরেস্টারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নৌকায় তুলে নেন দুটো কাঠ, খরকুটো, গোলপাতা। জঙ্গলে যাবার জন্য সরকারী পাস থাকলেও এইসকল বনজীবিদের খুব কম অংশই সেই কার্ড নিতে পারেন। কারন সরকারী বরাদ্দ কম। গত বছর যেখানে ছিল ৩৫০ কার্ড, এ বছর ২০০। সুন্দরবন রক্ষার জন্য এই আয়োজন। বরাদ্দ কম হলেও আওয়ামীলীগ, বি এন পি নেতারা সেই কার্ড হাতিয়ে নেন আগেই কারন এই কার্ড গুলোর নামে তথা কার্ডধারী বনজীবীদের নামে যে সরকারী সাহাজ্য আসে সেগুলোর লোভে। তাই এই সকল বনজীবীদের জঙ্গলে যেতে হয় চুরি করে, সরকারী কোন পাসের তোয়াক্কা না করে, ফরেস্টারকে টাকা দিয়ে। জঙ্গলে গিয়ে কাজ করা ছাড়া আর অন্য কোন কাজ নেই এই সকল গাজী, সর্দারদের। কিছু কিছু মানুষ যদিও মাইগ্রেট করছে, তবে সেটা সিজনাল। অন্য কোন জেলায় গিয়ে কিছু টাকা রোজগার করে আবার চলে আসে। আবার কিছু মানুষ বেনাপোল হয়ে দালাল ধরে চলে যায় ভারতে। সেখানে গিয়ে কাজ নেয় ইট ভাটায়। এই ইট ভাটা গুলোতে গিয়ে একবার ঢুকলে ৬ মাসের জন্য। সেখান থেকে ৬ মাসের আগে সে আর বের হতে পারবে না। যদি কেউ পালানোর চেষ্টা করে তবে তাকে শেকল দিয়ে বেধে রাখা হয় অথবা বি এস এফের কাছে তুলে দেয়া হয় আর সাথে অকথ্য নির্যাতন তো থাকছেই।
সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া এসব মানুষের কাছে সব চেয়ে বড় আতংকের নাম ডাকাত। বাঘের জন্য তারা পীরের কাছ থেকে ‘পড়া লাল রুমাল’ নিয়ে গেলেও এই ডাকাতদের কাছে তারা অসহায়। ডাকাতের জন্য কোন ‘পড়া লাল রুমাল’ নেই, নেই কোন মাদূলী-তাবিজ। কয়েক বছর আগে সুন্দরবনে ডাকাতী গ্রুপ ছিল ৩/৪ টা আর এখন ১০/১২ টার ও বেশি। জঙ্গল হল এ সব ডাকাতের রাজত্ব। পুলিশ, কোস্ট গার্ডদের কোন তোয়াক্কা করে না তারা। একেকটা ডাকাতি গ্রুপে ৩০/৪০ জন থেকে শুরু করে ১৫০/২০০ জন পর্যন্ত রয়েছে। রয়েছে অনেক আধুনিক অস্ত্র। যেগুলো আমাদের পুলিশ কিংবা কোস্ট গার্ডের কাছে শুধুই স্বপ্ন।
এই রকম একটা সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে কোস্ট গার্ড কিংবা পুলিশ কোন কিছু করে উঠতে পারে না বিধায় তারাও এই সব ডাকাতদেরকে ঘাটাতে যায় না খুব একটা। বীরদর্পে ডাকাতেরা ঘুরে বেড়ায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে। এমনকি তারা ফরেস্টারের বিছানায় পর্যন্ত ঘুমায়। সুন্দরবনের সব থেকে বড় ডাকাত গ্রুপ হল গামা গ্রুপ। এরপর রয়েছে রাজু গ্রুপ। রাজু হল গামার ভাগনা। মামা- ভাগনা হলেও তাদের মধ্যে কাটাকাটি সম্পর্ক। আগে তারা একই গ্রুপে ছিল। সুন্দরবনে অরাজকতা সৃষ্টি কারী এইসব ডাকাত গ্রুপ বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় এই নদী থেকে ঐ নদীতে। সুন্দরবনে মাছ ধরতে হলে একজন জেলেকে প্রতি চারমাসের জন্য, একজন ডাকাতকে ৬০০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এখন দেখা গেল একজন জেলে একজন ডাকাতকে ৬০০০ টাকা দিল, সেইখানে সে, সেই ডাকাতের কাছে ৪ মাসের জন্য সেফ কিন্তু অন্য কোন ডাকাতের হাতে পড়লে আবার তাকেও মুক্তি পন দিতে হবে। এছাড়াও এর সাথে রয়েছে ফরেস্টারের ঘুষের টাকা আবার মাছ/কাকড়া পাওয়ার অনিশ্চয়তা।
একটা কেসঃ
জনাব রহিম গাজী (ছদ্মনাম)। পেশায় বনজীবী। মোট ৬ জনের সংসার তার। জঙ্গলে গিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাকে। আগে সে তার নৌকায় ‘জন’ খাটাত। কিন্তু মজুরীর দাম বৃদ্ধির কারনে এবার সে আর জন না নিয়ে তার দুই ছেলের প্রাইমারী স্কুলের পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়ে তাদের নিয়ে যায় মাছ ধরতে। সুন্দরবনের নদীর একটা জায়গাটাকে সে মাছ ধরার জন্য নিরাপদ মনে করে, কারন এই জায়গায় ৬ মাস মাছ ধরার জন্য সে রাজু ডাকাত কে ৬০০০ টাকা দিয়েছে। মাছ ধরতে ধরতে, একদিন সে দেখে বড় কি একটা লঞ্চের মত তার নৌকার দিকে আসছে।
fisherman
তার আর বোঝার বাকী থাকে না যে এটা ডাকাতী নৌকা। সে তো টাকা দিয়েছে রাজু ডাকাতকে এই ভেবে সে বুকে সাহস নিয়ে আবারো মাছ মারতে থাকে। ডাকাতী নৌকা যখন তার নৌকার কাছে আসে তখন সে বুঝতে পারে যে এটা রাজু ডাকাত না। গামা ডাকাত। এসেই গামা ডাকাত তার নৌকায় থাকা চাল,ডাল,পানি, তরকারী, মাছ কেড়ে নেয়। তাকে মারধোর করা শুরু করে। এক পর্যায়ে সে যখন বলে যে সে রাজু ডাকাতকে টাকা দিয়েছে তখন তার উপর নেমে আসে আরো নির্যাতন। কেন সে রাজুকে টাকা দিবে? এক পর্যায়ে তাকে গামা ডাকাতের লোকজন নৌকায় তুলে নেয় এবং তার দুই সন্তানকে ছেড়ে দেয় এবং একটা বিকাশ নাম্বার দিয়ে বলে ৭ দিনের মধ্যে এই নাম্বারে ১০০০০ টাকা না দিলে তোর বাবাকে জবাই করে বাদায় (জঙ্গলে) ফেলে রাখব। রহিম গাজী এবং তার সাথে আরো ৩/৪ জন জেলেকে নিয়ে গামা ডাকাত চলে আসে। তারা গিয়ে ওঠে ফরেস্ট অফিসে। দুটো হরিন মারে তারা। ফরেস্ট অফিসের ভেতরে থাকে গামা ডাকাত এবং তার বাহিনী আর বাইরে বেঁধে ফেলে রাখা হয় রহিম গাজী এবং বাকী বন্দীদের। সারা রাত মশার কামড়ে অতিষ্ট হয়ে ওঠে তারা। হাত বাধা থাকার কারনে, মশা তাড়াতে না পেরে সারা রাত মশার খোড়াক হতে থাকে। রহিম গাজীর পরিবার ৭ দিনের মধ্যে টাকা না দিতে পারলে, ৮ম দিনে তারা রহিম গাজীকে তার বাড়িতে ফোন দিতে বলে, তারা। রহিম গাজী তাদের কথা মত ফোন দেয়। ফোনে কথা বলার সময় নৌকার বড় একটা কাঠ দিয়ে রহিম গাজীকে প্রচুর মারা হয়। কারন ফোনে যেন তার পরিবার রহিম গাজীর চিৎকার শুনতে পান। রহিম গাজীর পরিবার গামা ডাকাতের কাছে অনেক অনুরোধ করে আরো একটা দিন সময় চেয়ে নেন। পরের দিন তার পরিবার এলাকার মহাজনদের কাছে প্রতি হাজারে ২০০ টাকা হারে সুদে ১০০০০ টাকা ঋন নিয়ে গামা ডাকাতের দেয়া বিকাশ নাম্বারে পাঠিয়ে দেন কিন্তু সেদিন যখন তারা রহিম গাজীকে ছেড়ে দিবেন তার আগ মুহুর্তে সেখানে কোস্ট গার্ডের রেইড পরে। কোস্ট গার্ডের সাথে গামা ডাকাত গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধ হয়। প্রায় ৩/৪ ঘন্টা যুদ্ধের পর গামা ডাকাত রহিম গাজী এবং অন্যান্য বন্দীদের ফেলে রেখে চলে যায়। কোস্ট গার্ড বন্দীদের ডাকাত সন্দেহে তুলে নিয়ে যায় এবং জেলে রাখে। তাদের কথা আর কেউ শোনেনা। দেয়া হয় তাদের নামে ডাকাতি মামলা। সেই মামলায় তিন বছরের জেল হয় রহিম গাজীর। জেলে যাওয়ার কারনে, তার পরিবার একেবারে রাস্তায় বসে যায় কারন উপার্জন করার লোক বলতে তার পরিবারে সে ছাড়া আর কেউ ছিল না।
আইলায় সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া এইসব বনজীবিদের দুঃখ দূর্দশার কথা শোনার মানুষ অনেক কম। যদিও কয়রায় কিছু এন জি ও কাজ করে চলেছে কিন্তু তাদের সাহাজ্য সহায়তাও পর্যাপ্ত নয়। আর যদি সরকারী উদ্যেগের কথা বলি তবে সরকারী সাহাজ্য সহযোগীতা যা বরাদ্দ তা সরকারী কর্মচারী, চেয়ারম্যান-মেম্বার, দলীয় নেতা নেত্রীদেরই পেট ভরাতে পারেনা, সেখানে এই সব অসহায় মানুষের দুঃখ মোচন করবে কি করে? অবস্থা এতটাই খারাপ যে কোন বেসরকারী সাহাজ্য সংস্থাও যদি সেখানে সাহাজ্য করতে যায় তবে আগে চেয়ারম্যান, মেম্বার, দলীয় নেতা কর্মীদের উদর পূর্তী করাতে হয়। কিছুদিন ধরে খবরে জলদস্যু ধরা পরা মারা যাওয়ার বেশ কিছু খবর কানে আসছে। এটা একটা ভাল সংবাদ। কিন্তু ধরা কিংবা মারা পড়ছে কোন জলদস্যুরা? ধরা পড়ছে সেই সব চুনোপুটির দল যাদের প্রশাসনের সাথে আতাত নেই, প্রশাসনকে খুশি রাখে না। এটা একটা আই ওয়াশ ছাড়া আর কিছুই নয়। রাঘব বোয়ালেরা ঠিকই বহাল তবিয়তে চাঁদার জন্য বনজীবিদের অপহরন, খুন, জুলুম-নির্যাতন করেই চলেছে দিনের পর দিন। দেখার কেউ নেই।
Share:

No comments:

Post a Comment

Popular Posts

Search This Blog

Total Pageviews

Home Vision. Powered by Blogger.

Visitor Counter

Featured Post

Royal Bengal Tiger: The Icon of the Sundarbans

Labels

Blog Archive

Recent Posts